ফ্ল্যাট কেনার নিয়ম কানুন


 তিল তিল করে গড়া সঞ্চয়ে একজন ক্রেতা তাঁর নিজের জন্য একটি ফ্লাট ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন।অনেক কোম্পানীর কথা আর বাস্তবে কাজে সাথে অনেক ফারাক থাকায় আর ক্ষেত্র বিশেষে প্রতারনায় শিকার হয়ে ফিকে হয়ে যায় ফ্লাট কেনার স্বপ্নে বিভোর ক্রেতাটির আপন নীড়ে থাকার স্বপ্ন ! এ পরিস্থিতি এড়াতে হলে ফ্লাট ক্রেতারও কিছু রয়েছে দায়িত্ব। খুব সচেতনভাবেই সিদ্বান্ত নিতে হবে ফ্লাট ক্রেতাকে। ফ্লাট ক্রয়ের সময় সিদ্বান্ত নিতে ভূল করলে তা শুধরানো অনেক দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।ফ্লাট কেনার আগে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন; তা হলো –

১. আপনি যে প্রজেক্টে ফ্লাট ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, প্রথমে সে প্রজেক্টের রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত নকশার ফটোকপি নেবেন এবং সম্বভ হলে একটা অনুমোদিত প্লানের ফটোকপি সংগ্রহে রাখুন। ওই নকশা আসলেই রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত কিনা তা নিশ্চিত হোন। রাজউক অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মানের প্রবনতা বর্তমানে অনেকটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি।বিভিন্ন কোম্পানী বিভিন্নভাবে কম বেশি রাজউক অনুমোদনের বাহিরে ভবন নির্মানের কাজ করে থাকে যা আপনার জানা থাকলে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে মূলত নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া দরকার।

প্রথমত, ভবনের যে ড্রয়িংটা রাজউক অনুমোদিত ড্রয়িং হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা হতে পারে ভুয়া বা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তৈরী করা। এক্ষেত্রে ড্রয়িংটা সঠিক কিনা তা রাজউক অফিস হতে নিশ্চিত হয়ে নেয়া। রাজউকের ওয়েভ সাইট (www.rajuk.gov.bd) হতেও সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃত অর্থে কোন প্রজেক্টের জন্য রাজউক হয়তো অনুমোদন দিয়েছে ৭ তলা ভবন, কিন্তু বাস্তবে ভবন নির্মিত হয়েছে ৮ তলা। সুতরাং ৮ম তলায় নির্মিত ফ্লাট হবে অবৈধ। এধরনের কোন ফ্লাট আপনি কিনছেন কিনা তা অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। যাচাই বাছাই ব্যাতীত ফ্লাট কিনে অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন।

তৃতীয়ত, রাজউক অনুমোদন অনুযায়ী প্রতিটা ফ্লাট কত বর্গফুট হওয়া উচিত তার হিসাব খুব কম ক্রেতাই বুঝে নেন। ধরুন, রাজউক অনুমোদন মোতাবেক একটি ফ্লোরের নেট এরিয়া ১২০০ বর্গফুট এবং প্রতিটা ফ্লোরে করা হয়েছে ২টি ইউনিট। অর্থাৎ প্রতিটা ইউনিট হবে ৬০০ বর্গফুট। নীচতলায় ও ছাদের উপরে নিয়ম অনুযায়ী কমন এরিয়া যোগ করলে ফ্লাটের এরিয়া হবে কম-বেশি ৭০০ বর্গফুট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজউকের নিয়ম অমান্য করে এ ধরনের ফ্লাটকে ১১০০-১২০০ বর্গফুটে উন্নীত করা হয়। অর্থাৎ রাজউকের অনুমোদিত এরিয়ার চেয়ে বিক্রয়যোগ্য এরিয়া হিসাব করলে প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি! এ ধরনের ফ্লাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধান হতে হবে।

২. ভবনের স্থায়িত্ব ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বা কাঠামোগত নকশা। স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে মারাত্বক ত্রুটি থাকাটা সাভারের রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার অন্যতম কারন বলে মনে করা হয়। ফাউন্ডেশন, পিলার এবং বীম এ কয়টি কাটামোগত উপাদানে কোন ভাবেই দুর্বলতা থাকলে চলবেনা। এ জন্য অভিজ্ঞ এবং পেশাদার প্রকৌশলীর মাধ্যমে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করানো হয়েছে কিনা তা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ভবনের ষ্ট্যাকচারাল ডিজাইন সম্পন্নকারী প্রকৌশলীর নাম ও তার পেশাগত রেজিষ্ট্রেশন নম্বর জেনে নিতে পারেন।

৩. ভবনের বাহ্যিক আকৃতি ও সৌন্দর্য এবং ভিতরে জায়গার ব্যবহার উপযোগীতা হচ্ছে স্থাপত্য নকশার মুল প্রতিপাদ্য বিষয়। একজন স্থপতির দ্বারা এ কাজটি করা হয়ে থাকে। ভবনের প্রবেশ, চলাচল, আলো বাতাসের ব্যবস্থা, উপরে নীচে উঠা নামা, সর্ম্পূণ জায়গার লে-আউট, ভিতরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো কেমন হবে তার সম্পূর্ন নকশা করা হয়। ভবনের সার্বিক বসবাসের পরিবেশ, অগ্নি নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হলে স্থাপত্য নকশা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থপতি এবং প্রকৌশলীর সমন্বিত ডিজাইন না হলে ভবনে মারাত্বক ত্রুটি থেকে যেতে পারে।

অনেক ক্রেতা এ বিষয়গুলোর দিকে তেমন নজর না দিয়ে, ফ্লাট কত কম মূল্যে কেনা যায় সে দিকেই বেশি মনোযোগ দেন। ফলে, কমমূল্যে ফ্লাট ক্রয় করা সম্ভব হলেও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ফ্লাটে রয়ে যায় যা আরামদায়ক বসবাসের জন্য বেশ অনুপোযোগী। ফ্লাটক্রয়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। ভবনের স্থাপত্য নকশা প্রনয়নকারী স্থপতির নাম ও তার পেশাগত রেজিষ্ট্রশন নম্বর জেনে নিতে পারেন।

৪. জমির প্রকৃত পরিমান, মূল ফ্লাট এরিয়া এবং কমন এরিয়ার পরিমাপ জেনে নেবেন । কমন এরিয়া আসলে কতটুকু তা খুব কম প্রতিষ্ঠানই পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ধরুন, ৪৫০০ টাকা বর্গফুট দামে আপনি ফ্লাট ক্রয় করলেন। আপনার ফ্লাট এরিয়ার মধ্যে যদি মাত্র ২৫ বর্গফুট বেশি ধরা থাকে তাহলে আপনাকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হবে ১,১২,৫০০/- টাকা! অথচ মাত্র ২৫ বর্গফুট বেশি আছে কি নাই, তা কিন্তু আপনি স্বাভাবিকভাবে বুঝতে পারবেন না।

আসলে এ ধরনের বিষয়ের সাথে কোম্পানী কর্তৃপক্ষের সততা সরাসরি জড়িত। যাহোক, যত বর্গফৃট ফ্লাট এরিয়ার মূল্য আপনি পরিশোধ করবেন তার বিস্তারিত হিসাব (Break up) অবশ্যই লিখিতভাবে বুঝে নিবেন। বাউন্ডারী দেয়াল থেকে মূল ভবন পর্যন্ত আলো বাতাসের জন্য বাস্তবে কতটুকু জায়গা ছাড় দেয়া আছে তা জেনে নিন।

৫. প্লট বা জমির সব কাগজ পত্রের একসেট ফটোকপি সংগ্রহ করুন এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনকে দিয়ে পরীক্ষা করে নিন। জমির কাগজ পত্রের সাথে পাওয়ার অব এ্যাটর্নীর একটা কপি নিন । এসব কাগজ পত্র সঠিকভাবে না থাকলে আপনি ব্যাংক বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে লোন গ্রহন করতে পারবেন না। এমনকি ফ্লাট রেজিষ্ট্রেশন করার সময়ও ঝামেলা হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে ফ্লাট রেজিষ্ট্রেশন না হতেও পারে। সুতরাং এ বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।

৬. যে কোম্পানী হতে ফ্লাট কিনবেন তারা ইতিপূর্বে কোন প্রজেক্ট শেষ করেছে কিনা তার খোঁজ নিন। জেনে নিন ইতিপূর্বে তারা কি সময়মত প্রজেক্ট হ্যান্ডওভার করেছে ? যদি কোন প্রজেক্ট শেষ করে থাকে তাহলে প্রজেক্টের কাজের গুনগত মান কেমন তা জানার জন্য বাস্তবে সেই প্রজেক্ট ভিজিট করুন। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নিন। প্রজেক্টের কাজের মান পছন্দ হলে তবেই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিন।

৭. আপনি যে প্রজেক্টে ফ্লাট ক্রয় করবেন তা কি সময় মত হ্যান্ডওভার করতে পারবে বলে আপনি নিশ্চিত হতে পেরেছেন? প্রজেক্টটি কি আদৌ শেষ করতে পারবে বলে আপনার মনে হয়? ইতিবাচক জবাব যদি পান তবেই অগ্রসর হোন । যদিও এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া বেশ কঠিন, তবে যতটুকু সম্ভব খোঁজ নেবার চেষ্টা করুন।

৮. যে কোম্পানী হতে ফ্লাট কিনবেন তারা REHAB মেম্বার কিনা জেনে নিন এবং মেম্বারশীপ নম্বর (www.rehab-bd.org) কত তাও জেনে নিতে পারেন। যদি রিহ্যাব মেম্বার হয় তবে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে তার সমাধানে মধ্যস্থততা করার সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে।

৯. যে প্রজেক্ট থেকে ফ্লাট ক্রয়ের চিন্তা করছেন, তার নির্মান কাজ যদি চালু থাকে তাহলে প্রজেক্টটিতে মৌলিক মালামাল যেমন – রড, সিমেন্ট, পাথর, বালু, ইট ইত্যাদির গুনগতমান সম্পর্কে ভালো করে খবর নিন। প্রয়োজনে বাস্তবে তাদের প্রজেক্টগুলো ভিজিট করুন। মৌলিক মালামালের পাশাপাশি ফিনিশিং মালামালের গুনগতমান সম্পর্কে ভালো করে খবর নিন। মালামাল যতই ভালো হোক, যদি সুপারভিশন দক্ষ প্রকৌশলী দ্বারা করা না হয় তাহলে কাজ কখনই ভালো মানের হবে না। সুতরাং প্রজেক্টের কাজ দৈনিক নিয়মিত কে বা কারা সুপারভিশন করে সে ব্যাপারটিও জানতে হবে।

১০. অনেক প্রজেক্ট দেখা যায় কাজ শুরু করেও শেষ হচ্ছে না বা কাজ খুব ধীর গতিতে চলছে। এমন প্রজেক্টের ফ্লাট ক্রয় করলে সময়মত ফ্লাট হস্তান্তর হবে কি না তা বলা বেশ মুশকিল। অর্থাৎ প্রজেক্টের কাজ কবে শুর হয়েছে এবং তার বর্তমান স্ট্যাটাস সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

১১. কোম্পানী পরিচালনায় যাঁরা যুক্ত আছেন তারা কি সংশ্লিষ্ট কাজে প্রফেশনাল? তাদের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, আন্তরিকতা ও সততা খুবই গুরুত্বপূর্ন বিষয়, যা আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে ।কোম্পানী ব্যবস্থাপকরা যদি সংশ্লিষ্ট কাজে অপেশাদার হয় তাহলে তাদের সাথে চুক্তি করার পূর্বে অবশ্যই ভাবা দরকার।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনার বাহিরে অনেক বিষয় আছে যা বুদ্ধি বিবেক দিয়ে ও কারো সহায়তা নিয়ে যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন। এখানে যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা একজন ফ্লাট ক্রেতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনে কিছুটা সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: প্রকৌঃ মোঃ আতিকুর রহমান, কাউন্সিল মেম্বার, ঢাকা সেন্টার, আইইবি। 

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

No comments

Powered by Blogger.